বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯

কোন মেস্তরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়

কোন মেস্তরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়।।

চন্দ্র সুর্য বান্ধা রাখছে নায়েরই আগায়
দূরবিনে দেখিয়া পথ মাঝি-মাল্লায় বায়

রঙ-বেরঙের কত নৌকা ভবের তলায় আয়
রঙ-বেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায়।।

হারা-জিতার ছুবের বেলা কার পানে কে চায়
মদন মাঝি বড় পাজি কত নাও ডুবায়।।

বাউল আব্দুল করিম বলে বুঝে উঠা দায়
কোথা হতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা৩৭৪

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাঁটু গান গাইতাম।।

বর্ষা যখন হইত, গাজির গাইন আইত
রঙ্গে ঢঙ্গে গাইত আনন্দ পাইতাম
বাউল গান  ঘাঁটু গান আনন্দের তুফান
গাইয়া সারি গান নাও দৌড়াইতাম।।

হিন্দু বাড়িন্ত যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
কে হবে মেম্বার, কে হবে গ্রামসরকার
আমরা কি তার খবর লইতাম।।

বিবাদ ঘটিলে পঞ্চাইতের বলে
গরিব কাঙালে বিচার পাইতাম
মানুষ ছিল সরল ছিল ধর্মবল
এখন সবাই পাগল বড়লোক হইতাম।।

কবির ভাবনা সেই দিন আর পাব না
ছিল বাসনা সুখী হইতাম
দিন হতে দিন আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম।।


ভাটির চিঠি, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:২১১

মন মজালে ওরে বাউলা গান

মন মজালে ওরে বাউলা গান
যা দিয়েছো তুমি আমায় কী দেব তার প্রতিদান।।

অন্তরে আসিয়া যখন দিলে তুমি ইশারা
তোমার সঙ্গ নিলাম আমি সঙ্গে নিয়া একতারা
মন মানেনা তোমায় ছাড়া তোমাতে সঁপেছি প্রাণ।।

কী করে পাবো তোমারে তাই ভাবি দিন রজনী
মনের কথা প্রকাশ করি কথায় দিয়ে রাগিণী
এস্কে দিল-দরিয়ার পানি ভাটি ছেড়ে বয় উজান।।

তত্ত্ব গান গেয়ে গেলেন যারা মরমি কবি
আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ-দুর্দশার ছবি
বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তির বিধান।।



ভাটির চিঠি, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা২০৮

বড় ভাবী গো, আমারে ঠকোইছন আল্লায়

বড় ভাবী গো, আমারে ঠকোইছন আল্লায়
আম খালি চিন্তা করি আমি কিছু করবার নায়
একে তো অভাবের সংসার জমানা কঠিন
খাইয়া বাইচ্চা চলা যায় না করিতে হয় ঋণ।।

মা-বাপ যেমন পাগল রাতদিন
ভাবেন খালি আমার দায়
মা-বাপের গলার কাঁটা আমি অভাগিনী
জন্মিয়া মরলাম না কেনে ভাবি দিনরজনী
দামান্দের যে দাম শুনি
শুনলে কানে ধুমা যায়।।

ইদিগেও তিন-চারখানো বাবাজান গেলা
কম দামেনি জামাই মিলে খুঁজিয়া চাইলা
ছনের ঘরে থাকে জামাই
তবু টেলিভিশন চায়।।

কী পাপ করলাম গো ভাবি মাইয়া জন্ম লইয়া
মা-বাপের ডাকাতি করলাম জনমের লাগিয়া
জমি বেইচ্চা দিলে বিয়া
শেষে তাদের কী উপায়।।

নারী-পুরুষ সমান অধিকার শুনি শুনার শোনা
এই ব্যাপারে কী করা যায় তাই করি ভাবনা
করিম কয় দুঃখের বিষয়
মাইয়ার বাপ যে নিরুপায়।।


ভাটির চিঠিশাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ২৬৪

সয়ালের দয়াল বন্ধুরে

সয়ালের দয়াল বন্ধুরে
তুমি যে সরল
তোমর লাগিয়া রে বন্ধু
ভুবন পাগল রে।।

সয়ালের দয়াল রে বন্ধু
তুমি সর্বঘটে আছ
জীবের জীবন নাম ধরিয়া
স্বরূপে মিশেছ রে।।

লতায় পাতায় দেখি তোমার
দয়ার পরিচয়
দয়াময় বলে তোমারে
সর্বজীবে কয় রে।।

নিরাশ আঁধার মাঝে
আশার আলো তুমি
কাঙালের বন্ধু তুমি
তুমি অন্তর্যামী রে।।

পাগল আব্দুল করিম বলে
কী করবে শয়তানে
তুমি যারে কর দয়া
তোমার নিজ গুণে রে।।


কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৩০৯

রাখ কি মার এই দয়া করো

রাখ কি মার এই দয়া করো
থাকি না যেন তোমারে ভুলিয়া।।

নিশিদিনে, শয়নে-স্বপনে
পরানে পরানে মিশিয়া
এই আঁধার রাতে নেও যদি সাথে 
তুমি নিজে পথ দেখাইয়া।।

আমি তোমার পাগল, ভরসা কেবল
দীনবন্ধু তোমার নাম শুনিয়া
নেও যদি খবর, হইব অমর 
নামের সুধা-পান করিয়া।।

দয়াল নাম তোমার জগতে প্রচার
জীবেরে দয়া করো বলিয়া
আব্দুল করিম বলে, রেখ চরণতলে, 
দিওনা পায়ে ঠেলিয়া।।


কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা৩১০

মুর্শিদ ধন হে, কেমনে চিনিব তোমারে

মুর্শিদ ধন হে, কেমনে চিনিব তোমারে
দেখা দেও না কাছে নেও না আর কত থাকি দূরে।।

মায়াজালে বন্দি হয়ে আর কত কাল থাকিব
মনে ভাবি সব ছাড়িয়া তোমারে খুঁজে নেব
আশা করি আলো পাব ডুবি যাই অন্ধকারে।।

তন্ত্রমন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই
শাস্রগ্রন্থ পড়ি যত আরো দূরে সরে যাই
কোন সাগরে খেলতেছ লাই ভাবতেছি তাই অন্তরে।।

পাগল আব্দুল করিম বলে দয়া করো আমারে
নতশিরে করজোড়ে বলি তোমার দরবারে
ভক্তের অধীন হও চিরদিন থাকো ভক্তের অন্তরে।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ৩২৩