বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯

কোন মেস্তরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়

কোন মেস্তরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়।।

চন্দ্র সুর্য বান্ধা রাখছে নায়েরই আগায়
দূরবিনে দেখিয়া পথ মাঝি-মাল্লায় বায়

রঙ-বেরঙের কত নৌকা ভবের তলায় আয়
রঙ-বেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায়।।

হারা-জিতার ছুবের বেলা কার পানে কে চায়
মদন মাঝি বড় পাজি কত নাও ডুবায়।।

বাউল আব্দুল করিম বলে বুঝে উঠা দায়
কোথা হতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা৩৭৪

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাঁটু গান গাইতাম।।

বর্ষা যখন হইত, গাজির গাইন আইত
রঙ্গে ঢঙ্গে গাইত আনন্দ পাইতাম
বাউল গান  ঘাঁটু গান আনন্দের তুফান
গাইয়া সারি গান নাও দৌড়াইতাম।।

হিন্দু বাড়িন্ত যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
কে হবে মেম্বার, কে হবে গ্রামসরকার
আমরা কি তার খবর লইতাম।।

বিবাদ ঘটিলে পঞ্চাইতের বলে
গরিব কাঙালে বিচার পাইতাম
মানুষ ছিল সরল ছিল ধর্মবল
এখন সবাই পাগল বড়লোক হইতাম।।

কবির ভাবনা সেই দিন আর পাব না
ছিল বাসনা সুখী হইতাম
দিন হতে দিন আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম।।


ভাটির চিঠি, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:২১১

মন মজালে ওরে বাউলা গান

মন মজালে ওরে বাউলা গান
যা দিয়েছো তুমি আমায় কী দেব তার প্রতিদান।।

অন্তরে আসিয়া যখন দিলে তুমি ইশারা
তোমার সঙ্গ নিলাম আমি সঙ্গে নিয়া একতারা
মন মানেনা তোমায় ছাড়া তোমাতে সঁপেছি প্রাণ।।

কী করে পাবো তোমারে তাই ভাবি দিন রজনী
মনের কথা প্রকাশ করি কথায় দিয়ে রাগিণী
এস্কে দিল-দরিয়ার পানি ভাটি ছেড়ে বয় উজান।।

তত্ত্ব গান গেয়ে গেলেন যারা মরমি কবি
আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ-দুর্দশার ছবি
বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তির বিধান।।



ভাটির চিঠি, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা২০৮

বড় ভাবী গো, আমারে ঠকোইছন আল্লায়

বড় ভাবী গো, আমারে ঠকোইছন আল্লায়
আম খালি চিন্তা করি আমি কিছু করবার নায়
একে তো অভাবের সংসার জমানা কঠিন
খাইয়া বাইচ্চা চলা যায় না করিতে হয় ঋণ।।

মা-বাপ যেমন পাগল রাতদিন
ভাবেন খালি আমার দায়
মা-বাপের গলার কাঁটা আমি অভাগিনী
জন্মিয়া মরলাম না কেনে ভাবি দিনরজনী
দামান্দের যে দাম শুনি
শুনলে কানে ধুমা যায়।।

ইদিগেও তিন-চারখানো বাবাজান গেলা
কম দামেনি জামাই মিলে খুঁজিয়া চাইলা
ছনের ঘরে থাকে জামাই
তবু টেলিভিশন চায়।।

কী পাপ করলাম গো ভাবি মাইয়া জন্ম লইয়া
মা-বাপের ডাকাতি করলাম জনমের লাগিয়া
জমি বেইচ্চা দিলে বিয়া
শেষে তাদের কী উপায়।।

নারী-পুরুষ সমান অধিকার শুনি শুনার শোনা
এই ব্যাপারে কী করা যায় তাই করি ভাবনা
করিম কয় দুঃখের বিষয়
মাইয়ার বাপ যে নিরুপায়।।


ভাটির চিঠিশাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ২৬৪

সয়ালের দয়াল বন্ধুরে

সয়ালের দয়াল বন্ধুরে
তুমি যে সরল
তোমর লাগিয়া রে বন্ধু
ভুবন পাগল রে।।

সয়ালের দয়াল রে বন্ধু
তুমি সর্বঘটে আছ
জীবের জীবন নাম ধরিয়া
স্বরূপে মিশেছ রে।।

লতায় পাতায় দেখি তোমার
দয়ার পরিচয়
দয়াময় বলে তোমারে
সর্বজীবে কয় রে।।

নিরাশ আঁধার মাঝে
আশার আলো তুমি
কাঙালের বন্ধু তুমি
তুমি অন্তর্যামী রে।।

পাগল আব্দুল করিম বলে
কী করবে শয়তানে
তুমি যারে কর দয়া
তোমার নিজ গুণে রে।।


কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৩০৯

রাখ কি মার এই দয়া করো

রাখ কি মার এই দয়া করো
থাকি না যেন তোমারে ভুলিয়া।।

নিশিদিনে, শয়নে-স্বপনে
পরানে পরানে মিশিয়া
এই আঁধার রাতে নেও যদি সাথে 
তুমি নিজে পথ দেখাইয়া।।

আমি তোমার পাগল, ভরসা কেবল
দীনবন্ধু তোমার নাম শুনিয়া
নেও যদি খবর, হইব অমর 
নামের সুধা-পান করিয়া।।

দয়াল নাম তোমার জগতে প্রচার
জীবেরে দয়া করো বলিয়া
আব্দুল করিম বলে, রেখ চরণতলে, 
দিওনা পায়ে ঠেলিয়া।।


কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা৩১০

মুর্শিদ ধন হে, কেমনে চিনিব তোমারে

মুর্শিদ ধন হে, কেমনে চিনিব তোমারে
দেখা দেও না কাছে নেও না আর কত থাকি দূরে।।

মায়াজালে বন্দি হয়ে আর কত কাল থাকিব
মনে ভাবি সব ছাড়িয়া তোমারে খুঁজে নেব
আশা করি আলো পাব ডুবি যাই অন্ধকারে।।

তন্ত্রমন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই
শাস্রগ্রন্থ পড়ি যত আরো দূরে সরে যাই
কোন সাগরে খেলতেছ লাই ভাবতেছি তাই অন্তরে।।

পাগল আব্দুল করিম বলে দয়া করো আমারে
নতশিরে করজোড়ে বলি তোমার দরবারে
ভক্তের অধীন হও চিরদিন থাকো ভক্তের অন্তরে।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ৩২৩

রঙ্গিলা বাড়ই রে, তুমি নানান রঙের খেলা খেলো

রঙ্গিলা বাড়ই রে, তুমি নানান রঙের খেলা খেলো
আমি তোমার প্রেমের পাগল তোমায় বাসি ভালো।।

বাড়ই রে, তোমার কর্ম তুমি করো মিছা দোষী আমি
পুরাইতে তোমার বাসনা দেশ-বিদেশে ভ্রমি
আমার ঘরে থাক তুুমি তোমার ভাবে চলো।।

বাড়ই রে, করাও কী করি আমি ভাবি দিবানিশি
লোকে বলে কাগায় ধান খায় বেঙের গলায় ফাঁসি,
তোমার লাগি কুলবিনাশি বিফলে দিন গেলো।।

বাড়ই রে, যাক না জাতি হোক না ক্ষতি দুঃখ নাই রে আর
সত্য করে কও রে বাড়ই তুমি নি আমার
তোমার প্রেমে আব্দুল করিম মরে যদি ভালো।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৩৩৮

আমি তোমার কলের গাড়ি তুমি হও ড্রাইভার

আমি তোমার কলের গাড়ি তুমি হও ড্রাইভার
তোমার ইচ্ছায় চলে গাড়ি দোষ কেন পড়ে আমার।।

চলে গাড়ি হাওয়া ভরে, আজব কল গাড়ির ভিতর
নিচ দিকেতে চাকা ঘোরে সামনে বাতি জ্বলে তার।।

রত্নমানিক বোঝাই করা, প্রহরী সব দয়ে পাহারা
বাদি ছয়জন আছ তারা সুযোগে করে সংহার।।

কলের গাড়ি কুদরতে চলে, চলে না পেট্রোল ফুরাইলে
বাউল আব্দূল করিম বলে কুদরতের শান বোঝা ভার।।




কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ৩৪১

নাও বানাইল নাও বানাইল রে কোন মেস্তরি

নাও বানাইল নাও বানাইল রে কোন মেস্তরি
কোন সন্ধানে বানাইল নাও বুঝিতে না পারি
নাও বানাইল রে কোন মেস্তরি।।

সুজন মেস্তরি পাইয়া, ঐ নাও দিয়াছে গঠন করিয়া
বত্রিশ বান্ধের নৌকাখানা পাইক সারিসারি।।

চাইর রঙে রঙ লাগাইয়া, ঐ নাও দিয়াছে সুন্দর করিয়া
যে জন হয় সুজন নাইয়া রাখে যত্ন করে।।

আব্দুল করিম কয় ভাবিয়া, ঐ নাও যাবে যখন পুরান হইয়া
ঘাটের নৌকা ঘাটে থইয়া যাইবে বেপারী।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৩৭৩

আগের বাহাদুরী এখন গেলো কই

আগের বাহাদুরী এখন গেলো কই
চলিতে চরণ চলেনা দিনে দিনে অবশ হই

মাথায় চুল পাকিতেছে, মুখে দাঁত নড়ে গেছে
চোখের জ্যোতি কমেছে মনে, ভাবি চশমা লই।
মন চলেনা রঙতামাশায়, আলস্য এসেছে দেহায়
কথা বলতে ভুল পড়ে যায়, মধ্যে মধ্যে আটক হই।।

কমিতেছি তিলেতিলে, ছেলেরা মুরব্বী বলে
ভবের জনম গেল বিফলে, এখন সেই ভাবনায় রই।
আগের মতো খাওয়া যায়না, বেশি খাইলে হজম হয়না
আগের মতো কথা কয়না, নাচে না রঙ্গের বাড়ই।।

ছেলেবেলা ভালো ছিলাম, বড় হয়ে দায় ঠেকিলাম
সময়ের মুল্য না দিলাম, তাইতো জবাবদিহি হই।
যা হবার তা হয়ে গেছে, আব্দুল করিম ভাবিতেছে
এমন একদিন সামনে আছে একেবারে দরবেশ হই


কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৩৪২

মহাজনে বানাইয়াছে ময়ূরপঙ্খি নাও

মহাজনে বানাইয়াছে ময়ূরপঙ্খি নাও 
সুজন কান্ডারি নৌকা সাবধানে চালাও।।

বাইচ্ছা বাইচ্ছা পাইক তুলিয়া নাওখানা সাজাও
ঝোঁক বুঝিয়া ছাড়ো নৌকা সুযোগ যদি পাও।।

অনুরাগের বৈঠা বাইয়া প্রেমের সারি গাও
রঙ্গিলা বন্ধুর দেশে যাইতে যদি চাও।।

বাউল আবদুল করিম বলে বুঝিয়া নায়ের ভাও 
লক্ষ্য ঠিক রাখিয়া বাইও যাইতে সোনার গাঁও।।


কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা৩৭৫

ও রঙিলা নাইয়া রে রঙে বৈঠা বাইয়া রে

ও রঙিলা নাইয়া রে রঙে  বৈঠা  বাইয়া রে
কোন দেশে যাও রে মাঝি
আমারে যাও কইয়া রে।।

ভাটিয়াল পানি বাইয়া মাঝি
ভাটিয়াল গান গাইয়া রে
ভাটিয়াল হাওয়ায় ভাটিয়াল বাদাম দিয়াছ টানিয়া রে
লিলুয়া বাতাসে তোর নাও চলছে ধাইয়া ধাইয়া রে
ময়ূরপঙ্খি নাওখানা তোর
মধ্যে দিলা ছৈয়া রে।।

চন্দ্রসম রূপ রে মাঝি তোমারই বদনে রে
রূপের ছটা বিষম লেঠা লাগিল নয়নে রে
একটু টিকে যাওরে মাঝি নৌকাখান ভিড়াইয়া রে
তোর দেশে প্রাণ যাইতে চায়
তোর নৌকায় উঠিয়া রে।।

কিসের ভাই কিসের বন্ধু কিসের দয়ামায়া রে
এই দুনিয়া পুতুল খেলা দেখিনু ভাবিয়া রে
মন মানুষকে ধরব বলে মনে আশা নিয়া রে
করিম কয় আশার আশে
দিন গেল ফুরাইয়া রে।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৩৮৬

ভাবিলে কী হবে গো যা হইবার তা হইয়া গেছে

ভাবিলে কী হবে গো যা হইবার তা হইয়া গেছে।
জাতি কুল যৌবন দিয়াছি, প্রাণ যাবে তার কাছে গো
যা হইবার তা হইয়া গেছে । ।

কালার সনে প্রেম করিয়া কালনাগে দংশিছে
ঝাড়িয়া বিষ নামাইতে পারে এমন কি কেউ আছে গো।।

পিরিত পিরিত সবাই বলে, পিরিত যে কইরাছে
পিরিত করিয়া জ্বইলা-পুইড়া কতজন মরছে গো।।

আগুনের তুলনা হয়না, প্রেম আগুনের কাছে
নিভাইলে নিভে না আগুন কি কইরা প্রাণ বাঁচে গো

বলে বলুক লোকে মন্দ, কুলের ভয় কি আছে
আব্দুল করিম জিতে মরা বন্ধু পাইলে বাঁচে গো।।




কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৩৮৭

বসন্ত বাতাসে ও সই গো বসন্ত বাতাসে

বসন্ত বাতাসে ও সই গো বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে
সই গো বসন্ত বাতাসে।।

বন্ধুর বাড়ি ফুল বাগানে নানান বর্ণের ফুল
ফুলের গন্ধে মনানন্দে ভ্রমর আকুল
সই গো বসন্ত বাতাসে।।

বন্ধুর বাড়ি ফুলের টঙ্গি বাড়ির পুর্বধারে,
সেথায় বসে বাজায় বাঁশি, মন নিলো তার সুরে
সই গো বসন্ত বাতাসে।।

মন নিলো তার বাঁশির গানে রূপে নিলো আঁখি,
তাইতো পাগল আব্দুল করিম আশায় চেয়ে থাকি
সই গো বসন্ত বাতাসে।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৩৮৯

সখি কুঞ্জ সাজাও গো

সখি কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
মনে চায় প্রাণে চায় দিলে চায় যারে-
সখি কুঞ্জ সাজাও গো।।

বসন্ত সময়ে কোকিল ডাকে কুহু সুরে
যৌবনের বসন্তে মন থাকতে চায় না ঘরে।।

নয়ন যদি ভোলে সইগো মন ভোলে না তারে
প্রেমের আগুন হইয়া দ্বিগুণ দিনে দিনে বাড়ে।।

আতর গোলাপ চুয়াচন্দন আনো যত্ন করে
সাজাও গো ফুলের বিছানা পবিত্র অন্তরে।।

আসে যদি প্রাণবন্ধু দুঃখ যাবে দূরে
আমারে যে ছেড়ে যায় না প্রবোধ দিও তারে।।

আসিবে আসিবে বলে ভরসা অন্তরে
করিম কয় পাই যদি আর ছাড়িব না তারে।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৩৯০

কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি

কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি
কেমনে রাখিব তোর মন আমার আপন ঘরে বাঁধি রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবায় যদি।।

পাড়া-পড়শি বাদি আমার, বাদি কাল ননদী
মরম জ্বালা সইতে নারি দিবানিশি কাঁদি রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবায় যদি।।

কারে কী বলিব আমি নিজেই অপরাধী
কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বহাইলাম নদী রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবায় যদি।।

পাগল আব্দুল করিম বলে হল এ কী ব্যাধি?
তুমি বিনে এ ভুবনে কে আছে ঔষধি রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবায় যদি।।




কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৩৯৬

আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা

আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা
কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া ।।

না আসিলে কালো ভ্রমর, কে হবে যৌবনের দোসর
সে বিনে মোর শূন্য বাসর আমি জিয়ন্তে মরা ।।

কুলমানের আশা ছেড়ে, মনপ্রাণ দিয়েছি যারে
এখন সে কাঁদায় আমারে, এই কী তার প্রেমধারা ?

শুইলে স্বপনে দেখি, ঘুম ভাঙ্গিলে সবই ফাঁকি
কত ভাবে তারে ডাকি তবু সে দেয় না সাড়া ।।

আশা পথে চেয়ে থাকি, তারে পাইলে হবো সুখি
এ করিমের মরণ বাকি, রইল সে যে অধরা ।।





কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৪০২

আমার বন্ধুরে কই পাব গো সখি

আমার বন্ধুরে কই পাব গো সখি আমারে বলো না
বন্ধু বিনে পাগল মনে বুঝাইলে বুঝে না গো সখি
আমারে বলো না।।

সাধে সাধে ঠেকছি ফাঁদে দিলাম ষোলোআনা
প্রান পাখি উড়ে যেতে চায় আর ধৈর্য মানে না গো সখি
আমারে বলো না।।

কী আগুণ জ্বালাইলো বন্ধে নিভাইলে নিভে না
জল ঢালিলে দ্বিগুণ জ্বলে উপায় কী বলো না গো সখি
আমারে বলো না।।

পাগল আব্দুল করিম বলে অন্তরের বেদনা
সোনার বরণ রুপের কিরন না দেখলে বাঁচি না গো সখি
আমারে বলো না।।




কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ৪০৩

হাত বান্ধিব পাও বান্ধিব মন বান্ধিব কেমনে

হাত বান্ধিব পাও বান্ধিব মন বান্ধিব কেমনে
তোমরা যে বুঝাও গো সখি মনে কি মানে।।

লোকে বলে কলঙ্কিনী, কলঙ্কের ভয় নাই মনে
বিনামূল্যে বিকাইলে নি প্রাণবন্ধে আমায় কিনে।।

আহার না চায় গো মনে নিদ্রা নাই দুই নয়নে
কী সুখে যায় দিনরজনী তন জানে আর মন জানে।।

সোনার অঙ্গ পুড়ে অঙ্গার বন্ধুর প্রেমের আগুনে
জল ঢালিলে দ্বিগুন জ্বলে নিভাব আর কেমনে।।

পাগল আবদুল করিম বলে প্রাণ কাঁদে বন্ধু বিনে
মনে লয় তার সঙ্গে যাইতাম ছাই দিয়া কুলমানে।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৪০৯

শ্যামলও সুন্দরও রূপ আমি যেদিন হইতে হেরি গো

শ্যামলও সুন্দরও রূপ আমি যেদিন হইতে হেরি গো
পাগল মনে আমার লয় না ঘরবাড়ি।।

আমি কি আর দুঃখ ছেড়ে সই গো সুখের আশা করি
মনপ্রাণ দিয়াছি যারে আমি কেমনে পাশরি গো।।

পিপাসী চাতকীর মতো সই গো অহরহ ঝুরি
মনে লয় যোগিনীর বেশে আমি হইতাম দেশান্তরী গো।।

ধনে হীন মানে হীন আমি কাঙাল বেশে ঘুরি
দয়া নি করিবা বন্ধে আমায় জানিয়া ভিখারি গো।।

বাউল আবদুল করিম বলে বন্ধু অকূলের কান্ডারি
বন্ধের নামেতে কলঙ্ক রবে আমি যদি ডুবে মরি গো।।




কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৪১৫

পিরিতি মধুর মিলনে স্বর্গ শান্তি আসে

পিরিতি মধুর মিলনে স্বর্গ শান্তি আসে
পোড়া প্রাণ  জুড়াবে কিসে
বন্ধু নাই যার দেশে গো-
পিরিতি মধুর মিলনে।।

সোনা বন্ধু আসিলে আমার বাড়ি থাকিলে
বনফুল তুলিয়া
বিনা সুতে হার গাঁথিয়া গলেতে পরাইয়া গো।।

ফুল বিছানা সাজাইয়া আতর গোলাপ ছিটাইয়া
মোমবাতি জ্বালইয়া
প্রেমের বালিশ প্রেমের তোষক মশারি টাঙ্গাইয় গো।।

বন্ধু আমার রসিক চান বাটাতে সাজাইয়া পান
লং এলাচি দিয়া
আদর করে বন্ধুর মুখে দিব পান তুলিয়া গো।।

পাইলে সোনা বন্ধুরে সকল জ্বালা যায় দূরে
আদরে বসাইয়া
করিম কয় মরণ ভালো বন্ধুরে দেখিয়া গো।।



কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা৪২০

সখি তোরা প্রেম করিও না পিরিত ভালো না

সখি তোরা প্রেম করিও না পিরিত ভালো না
পিরিত করছে যে জন জানে সে জন পিরিতের কী বেদনা।।

প্রেম করে ভাসল সাগরে অনেকে পাইল না কূল
জগত জুড়ে বাজে শোন পিরিতের কলঙ্কের ঢোল
দিতে গিয়ে প্রেমের মাশুল মান-কুলমান থাকেনা।।

লাইলি-মজনু শিরি-ফরহাদ ওদের খবর রাখ নি
ইউসুফের প্রেমে জুলেখার হয় কত পেরেশানি
নবির প্রেমে ওয়াসকরনি যার প্রেমের নাই তুলনা।।

পিরিত পিরিত সবাই বলে পিরিতি সামান্য নয়
কলঙ্ক অলঙ্কার করে দুঃখের বোঝা বইতে হয়
কাম হইতে হয় প্রেমের উদয় প্রেম হইলে কাম থাকেনা।্

প্রেমিকের প্রেম-পরশে শুদ্ধ প্রেমের উদয়
প্রেমিক যে জন সেই মহাজন নাই তার ঘৃণা লজ্জা ভয়
বাউল আব্দুল করিমে কয় অপ্রেমিকে বোঝে না।।
 


কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:৮২৫

জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে বলো ওগো সাঁই

জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে বলো ওগো সাঁই
এ জীবনে যত দুঃখ কে দিয়াছে বল তাই।।

দোষ করিলে বিচার আছে সেই ব্যবস্থা রয়ে গেছে
দয়া চাইনা তোমার কাছে আমার উচিত বিচার চাই
দোষী হলে বিচারে সাজা দিবা তো পরে
এখন মারো অনাহারে কোন বিচারে জানতে চাই।।

এই কি তোমার বিবেচনা কেউরে দিলা মাখন ছানা
কেউর মুখে অন্ন জুটে না ভাঙা ঘরে ছানি নাই
জানো শুধু ভোগবিলাস জানো গরিবের সর্বনাশ
কেড়ে নেও শিশুর মুখের গ্রাস তোর মনে কি দয়া নাই।।

তোমার এমন ব্যবহারে অনেকে মানে না তোমারে
কথায় কথায় তুচ্ছ করে আগের ইজ্জত তোমার নাই
রাখতে চাইলে নিজের মান সমস্যার করো সমাধান
নিজের বিচার নিজেই করো আদালতের দরকার নাই।।

দয়াল বলে নাম যায় শোনা কথায় কাজে মিল পড়েনা
তোমার মান তুমি বোঝ না আমরা তো মান দিতে চাই
তুমি আমি এক হইলে পাবে না কোন গোলমালে
বাউল আবদুল করিম বলে আমি তোমার গুণ গাই।।


কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ৪৪৫

আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু করলায়রে দিওয়ানা

আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু করলায়রে দিওয়ানা
সুখ বসন্ত সুখের কালে শান্তি তো দিলায় না রে
বন্ধু, আইলায় নারে।।

অতি সাধের পিরিত বন্ধু রে, ওরে বন্ধু নাই রে যার তুলনা
দারুণ বিচ্ছেদের জ্বালা আগেতো জানি না রে
বন্ধু, আইলায় নারে।।

গলে মোর কলংকের মালা রে, ও রে বন্ধু কেউ ভালবাসে না
কুলমান দিয়া কী করিব আমি তোমারে যদি পাই না রে
বন্ধু, আইলায় নারে।।

আব্দুল করিম কুলমান হারা রে, ও রে বন্ধু তুমি কি জান না
সুসময়ে সুজন বন্ধু দেখাতো দিলায় নারে
বন্ধু, আইলায় নারে।।




কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা৩৯৯

বন্ধু দরদিয়ারে

বন্ধু দরদিয়ারে
আমি তোমায় চাইরে বন্ধু
আর আমার দরদি নাই রে।।

না জেনে করেছি কর্ম,
দোষ দিব আর কারে
সর্পের গায় হাত দিয়াছি 
বিষে তনু ঝরে রে
আর আমার দরদি নাই রে।।

আমার বুকে আগুন বন্ধু
তোমার বুকে পানি
দুই দেশে দুই জনার বাস
কে নিভায় আগুনি রে
আর আমার দরদি নাই রে।।

জন্মাবধি কর্ম পোড়া
ভাগ্যে না লয় জোড়া
করিমরে করবায় নাকি
দেশের বাতাস ছাড়া রে
আর আমার দরদি নাই রে।।


কালনীর কূলে, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ১৩২

রঙ্গের দুনিয়া তরে চাই না

রঙ্গের দুনিয়া তরে চাই না
দিবা-নিশি ভাবি যারে
তারে যদি পাই না।।

বন্ধুর প্রেমে পাগলিনী
শান্তি নাই দিন-রজনী
কুলহারা কলঙ্কিনী
কারো কাছে যাই না।।

প্রাণবন্ধুর সঙ্গ নিলাম
ভালোবেসে মনও দিলাম
পুর্বেই যাহা ভেবেছিলাম
এখন ভাবি তাই না।।


আসি বলে গেলো চলে
ভাসি সদাই নয়ন জলে
বাউল আব্দুল করিম বলে
রঙ্গের গান আর গাই না।।



কালনীর কূলে, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা:১২৫,

আমি কুলহারা কলঙ্কিনী

আমি কুলহারা কলঙ্কিনী
আমারে কেউ ছুঁইও না গো সজনী।।

প্রেম করে প্রাণবন্ধুর সনে
যে দুঃখ পেয়েছি মনে
আমার কেঁদে যায় দিন-রজনী।।

প্রেম করা যে স্বর্গের খেলা
বিচ্ছেদে হয় নরক জ্বালা
আমার মন জানে, আমি জানি।।

সখি গো উপায় বলনা
এ জীবনে দূর হলনা
বাউল করিমের পেরেশানি।।



কালনীর কূলে, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ১২৪

ঘৃণা লজ্জা ভয় থাকিতে প্রেম হবে না

ঘৃণা লজ্জা ভয় থাকিতে
প্রেম হবে না
যে করে আত্মসমর্পন 
তার প্রেমে আর গোল বাঁধে না।।

প্রেমের বাতাস লাগে যার গায়
দেখিলে তারে চেনা যায়
প্রমাণ দেয় ভাব ভঙ্গিমায় 
আত্মসুখের ধার ধারে না।।

পঞ্চরসে মাখা যেজন
রসিক সুজন সে মহাজন
অন্তরে তার পরশ রতন
সে করে স্বরূপ সাধনা।।

শুদ্ধপ্রেম যার ভাগ্যে ঘটে
আঁধারে তার চন্দ্র ওঠে
আব্দুল করিম প্রেমের হাটে 
সময়ে যাইতে পারল না।।



কালনীর কূলে, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ৭৬

গাড়ি চলে না, চলে না

গাড়ি চলে না, চলে না
চলে না রে 
গাড়ি চলে না।।

চড়িয়া মানবগাড়ি
যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি
মধ্য পথে ঠেকল গাড়ি 
উপায়-বুদ্ধি মিলে না।।

মহাজনে যত্ন করে
পেট্রল দিল টেংকি ভরে
গাড়ি চালায় মন ড্রাইভারে 
ভাল-মন্দ বোঝে না।।

গাড়িতে পেসিঞ্জারে
অযথা গণ্ডগোল করে
হেন্ডিম্যান কন্টেকটারে
কেউর কথা কেউ শুনে না।।

পার্সগুলো সব ক্ষয় হয়েছে
ইঞ্জিনে ময়লা জমেছে
ডায়নমা বিকল হয়েছে 
লাইটগুলা ঠিক জ্বলে না।।

ইঞ্জিনে ব্যতিক্রম করে
কন্ডিশন ভালো নয় রে
কখন জানি ব্রেকফেল করে 
ঘটায় কোন দুর্ঘটনা।।

আব্দুল করিম ভাবছে এবার
কন্ডেম গাড়ি কী করবো আর
সামনে বিষম অন্ধকার 
করতেছি তাই ভাবনা।।


কালনীর কূলে, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ৮৯,

আমি গান গাইতে পারি না

আমি গান গাইতে পারি না
গানে মিলে প্রাণের সন্ধান
গান গাওয়া মোর হলনা।।

জানিনা ভাব-কান্তি 
গাইতে পারি না সেই গান
যে গান গাইলে মিলে
আঁধারে আলো সন্ধান
গান গাইলেন লালন, রাধারমণ,
হাসন রাজা দেওয়ানা।।

আরকুম শাহ্, ফকির শিতালং 
বলেছেন মারফতি গাও
সৈয়দ শাহ্ নুরের গানে
শুকনাতে দৌড়াইলেন নাও
করিম বলে প্রাণ খুলে গাও 
গাইতে যার বাসনা।।



কালনীর কূলে, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ৭৯

মাটির পিন্জিরায় সোনার ময়না রে

মাটির পিন্জিরায় সোনার ময়না রে
তোমারে পুষিলাম কত আদরে।
তুমি আমার আমি তোমার এই আশা করে-
তোমারে পুষিলাম কত আদরে।।

কেন এই পিন্জিরাতে তোমার বসতি
কেন পিন্জিরার সনে তোমার পিরিতি
আসা-যাওয়া দিবারাতি ঘরে বাহিরে-
তোমারে পুষিলাম কত আদরে।।

তোমর ভাবনা আমি ভাবি নিশি দিন
দিনে দিনে পিন্জিরা মোর হইল মলিন
পিন্জিরা ছাড়িয়া একদিন যাইবে উড়ে-
তোমারে পুষিলাম কত আদরে।।

আব্দুল করিম বলে ময়না তোমারে বলি
তুমি গেলে হবে সাধের পিন্জিরা খালি
কে শুনাবে মধুর বুলি বল আমারে-
তোমারে পুষিলাম কত আদরে।।



কালনীর কূলে, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ৮৮

পিরিতি করিয়া বন্ধে ছাড়িয়া গেল

পিরিতি করিয়া বন্ধে
ছাড়িয়া গেল
আগে তো জানিনা বন্ধের
মনে কি ছিল।।

শোন ওগো সহচরি
ধৈর্য্য না ধরিতে পারি
না দেখিলে প্রাণে মরি 
উপায় কি বলো।।

প্রেম কী হয় যথাতথা
প্রেম করা কি মুখের কথা
প্রেমে যে দারুন ব্যথা
অন্তর বেধিল।।

পূর্ব কথা মনে আছে
সেদিন আজ চলে গেছে
চিরদিন থাকিবে কাছে
এই আশা ছিল।।


বাউল আব্দুল করিম বলে
প্রাণ জ্বলে বিচ্ছেদ অনলে
প্রাণবন্ধু যাইবার কালে 
সঙ্গে না নিল।।



কালনীর কূলে, শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্রপৃষ্টা: ৯৪